
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক, সাবেক ছাত্রনেতা মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন এখানে কেঁদে কোন লাভ নেই, আমি যতবার এসেছি স্বজনদের কান্নায় আমিও কেঁদে ফেলেছি। কিন্তু এই কান্না আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুনেননা। তার মন্ত্রি সবার সদস্যরা কখন কি বলেন তা তারা নিজেরাও জানে না। আপনারা জানেন আমিও ৪০ ঘন্টা বন্দি ছিলাম। আমার চোখ বেধে কোথায় কোথায় ২ ঘন্টা ঘুরিয়েছে আমি জানি না। আমাকে যে বন্দিশালায় রাখা হয়েছিল তা মনে হচ্ছে আয়না ঘরের মতই। একটি খাট পাতা একটু হাটা চলা ছাড়া কিছুই করা যায় না। সেখানে কোন জানলাও নেই। আমি ৪০ ঘন্টা ছিলাম। এখানে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। তিনি সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন আয়না ঘর বলে কিছু নেই। তাহলে এর পরিস্কার ব্যাখ্যা দিন। যাদের বিরুদ্ধে আয়না ঘরের অভিযোগ করা হয়েছে তাদেরও ব্যাখ্যা করা উচিত। অভিলম্বে গুম হওয়া স্বজনদের পরিবারের কাছে তাদের সদস্যদের ফিরিয়ে না দিলে এর পরিনতি খুবই খারাপ হবে যা আপনারা চিন্তা ও করতে পারছেন না।
‘বাবার লাশ ফেরত দেন, একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই, ছেলে বেঁচে আছে কিনা সন্ধান দেন; ভাইকে যদি মেরে ফেলেন, এক মুষ্টি মাটি দেওয়ার জন্য লাশটা ফেরত দেন’- স্বজনহারা পরিবারের সদস্যদের এরকম আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছিল জাতীয় জাদুঘর এলাকা।
আজ ৩০ আগস্ট, আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে দিবসটি পালিত হচ্ছে। মায়ের ডাক এর উদ্যোগে আজ সকাল ১০ টায় শাহবাগ জাদুঘরের সামনে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মানববন্ধন কর্মসূচীতে তিনি এসব কথা বলেন।
মায়ের ডাকের সমন্বয়নকারী আফরোজা ইসলাম আখির সভাপতিত্বে ও মোঃ মঞ্জুর হোসেন ঈসার সঞ্চালনায় সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন ঢাবির সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরু, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ভূইয়া ফুয়াদ, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মাহবুব হোসেন, গুম হওয়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সানজিদা ইসলাম তুলি, গুম হওয়া তপন দাসের স্ত্রী সুমী রানি দাস, গুম কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া, গুম রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা আলহাজ্ব সালেহা বেগম, গুম ইসমাইল হোসেন বাতেনের মেয়ে আনিসা ইসলাম ইনশা, ক্রস ফায়ারে নিহত বি-বাড়ীয়ার শাহিনুরের ভাই মেহেদী হাসান, গুম পিরোজপুরের নাসির উদ্দিন মিন্টুর ভাই আলআমিন, সূত্রাপুরের ছাত্রদল নেতা সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা পারভীন মুন্নী, ব্যারিস্টার আরমানের মা আয়েশা খাতুন, আল মুকাদ্দেসের চাচা আব্দুল হাই, গুম রাশেদের ভাই লোটাস, গুম মনির হোসেনের ভাই শহিদুল্লাহ, লক্ষীপুরের ওমর ফারুকের ছেলে ঈমন ওমর, গুম কমিশনার চৌধুরী আলমের ভাই খোরশেদ আলম সহ শতাধিক পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মানববন্ধনে গুমের শিকার সেলিম রেজা পিন্টুর বোন রেহেনা পারভীন মুন্নী বলেন, প্রশাসনের লোক পরিচয়ে সেলিম রেজাকে ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে তুলে নেওয়া হয়। আজ পর্যন্ত তার খোঁজ পাইনি। আমরা প্রথমে জিডি এবং পরে মামলা করেছি। পুলিশে, ডিবিতে গিয়েছি। মানবাধিকার কমিশনের কাছে গিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনারা মানবতাবিরোধীদের বিচার করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার করেছেন, আমার ভাইকে এত বছর ধরে গুম করে রাখা হয়েছে- এটা কি মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়? দেশে কি কোনও আইন, বিচার নেই? প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে বিচার দিয়ে গেলাম। আমার আব্বা মারা গেছে, আম্মা মৃত্যুশয্যায়। আমরা কি ভাইকে দেখে যেতে পারব না?
গুমের শিকার মোহন মিয়ার বাবা শমসের আলী বলেন, ২০১৮ সালে আমার পাশে ঘুমিয়ে ছিল মোহন। সেখান থেকে গভীর রাতে র্যাব তাকে তুলে নিয়ে যায়। আমি মামলা করেছি, হাইকোর্টে রিট করেছি। র্যাব অফিসে গিয়েছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমারে ছেলের খোঁজ পাইনি। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, আমার ছেলের কী দোষ? আমাদের কি বাঁচার অধিকার নেই? তাহলে কেন প্রশাসনকে দিয়ে গুম করা হবে। আমার এর বিচার চাই।
২০১৯ সালের ১৯ জুন মিরপুরের মাজার রোডের প্রথম কলোনির ২১-এ/ই, লালকুঠির বাসা থেকে বের হওয়ার পর ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেনকে গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে একদল ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায়। পরদিন ছোট ভাই খায়রুল শাহআলী থানায় সাধারণ ডায়েরি করলেও এখনো পুলিশ কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। ইসমাইলের মেয়ে আনিসা ইসলাম ইনসা বলেনÑ ‘বাবা বেঁচে আছে কিনা, কোথায় আছে সেটা আমরা জানতে চাই। বাবার অপেক্ষায়। বাবাকে ফিরিয়ে দেন, বাবাকে ফিরিয়ে দেন।’
গুম হওয়া কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সেতুর স্ত্রী জিনিয়া বলেন, স্বামীর সন্ধানে সবার কাছে গিয়েছি। মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ ও র্যাবের দপ্তরে ধরনা দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। বিভিন্ন ব্যক্তি স্বামীকে উদ্ধার করার জন্য টাকা চেয়েছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন জনকে প্রায় ১ কোটি টাকা দিয়েছি। তারপরও স্বামীকে পাইনি। এটা তো আমাদের সরকার। আমরা কেন গুম হব?’
২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে ভাটারা থানাধীন বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে একদল ব্যক্তি ধরে নিয়ে যায়। প্রায় সাড়ে ৬ বছর পরও তপু ফিরে আসেনি। তপুর মা বলেন, আমি তো আজও বিশ্বাস করতে পারি না যে আমাদের সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আমার ছেলে গুম হবে। আমি কার কাছে বিচার দিব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার তপুকে ফিরিয়ে দিন। তপু কোনো দোষ করলে তার বিচার করুন। তাই বলে মায়ের আঁচল আপনি খালি করে রাখবেন না।’
২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স’ সম্মেলনে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। এর পরের বছর থেকে দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী।
বক্তারা বলেন, ২০০৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছেন। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেছেন, বিশেষ বাহিনী- র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে ১৯৭০ ও ৮০-র দশকে কেবল অবৈধ অস্ত্র কারবারি ও ভিন্নমতাবলম্বীরাই গুম হতেন। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর নেতা, মাদক কারবারি ও মানবপাচারকারীদের মধ্যেও গুমের ঘটনা দেখা যায়।
গুম হওয়াদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি জানিয়েছেন, দেশের বাইরে আমেরিকায় জাতিসংঘের সদর দপ্তর, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া পার্লামেন্টের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন প্রবাসী নেতারা। এর মধ্যে আমেরিকায় যে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে সে কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন গুম হওয়াদের স্বজনদের একটি অংশ।