বেসরকারি খাতে কর্মরতদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে-প্রকৌশলী নাজিমুদ্দিন পাটোয়ারী

বিকাশমান বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক সূচক, কর্মসংস্থান ও অপরিহার্য পরিসেবার কর্মযজ্ঞে বেসরকারি খাতের গুরুত্ব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯০র দশকে দেশে বেসরকারিখাতের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান পরিলক্ষিত না হলেও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জাতীয় জিডিপিতে শিল্প ও সেবা, নির্মাণ, কৃষি, পরিবহন, উৎপাদনে বেসরকারি খাতে ৬৭ ভাগ অবদান ছিল। বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রগতিশীল ভিশনারি নেতৃত্বে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ক্রমেই পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ ধারণাটা গুরুত্ব পাচ্ছে।
বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ২২৬৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের রেকর্ড কিংবা বিশাল কর্মসংস্থান সুযোগ সবই বেসরকারিখাতের উদ্যোক্তা ও কর্মীদের কর্মনিষ্ঠার ফসল। বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি মেগা প্রকল্প, হাইটেকপার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সম্ভাবনার যে দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে, সেখানে ব্যাপক সংখ্যক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। বেসরকারিখাতের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে দক্ষ জনশক্তির প্রাধান্য থাকবে, সেটি নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।
বিশ্বের যে সকল দেশ আজ অর্থনৈতিক ও জীবনমানের মানদন্ডে শীর্ষে অবস্থান করছে, সেখানে ব্যক্তিখাত বা বেসরকারি খাতে ভূমিকা বলতে গেলে আকাশচুম্বি। এই বিকাশমান বেসরকারিখাতে কর্মীর চাকরির নিশ্চয়তা, প্রাপ্য বেতন মজুরী, কর্মঘন্টা সবকিছু আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার নির্দেশনায় নির্ধারিত বা পরিচালিত। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ব্যক্তিখাতে উদ্যোক্তরা রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থায় এতোটাই প্রভাব বিস্তার করে আছে, তাতে বেসরকারিখাতকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিকাশমান বেসরকারিখাত এখনো শ্রমব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উপনীত হতে পারেনি। বরং, বলা যায়-কর্মীর শ্রমশোষণই তাদের মুনাফার অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা রাখছে। আপাতত দৃষ্টিতে বেসরকারিখাতের শৈন শৈন উন্নতি লক্ষ্য করা গেলেও, শ্রমব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার কারণে এক সময় এখাত মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশাল কর্মীবাহিনীকে শোষণ ও বঞ্চনার মাঝে রেখে প্রকৃতঅর্থে একটি সেক্টরের উন্নয়ন স্থিতিশীল হতে পারে না। যখন তখন কর্মী ছাঁটাই, ন্যায্য মজুরী প্রদানে মালিকপক্ষের অনীহা, চাকরির অনিশ্চয়তা কখনো কর্মীদের উন্নয়নবান্ধব মানসিকতার পথে ধাবিত করে না। বাংলাদেশে বিকাশমান অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য এটিই অন্যতম কারণ। অন্যদিকে যে সকল বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্মীবান্ধব বা অংশীদারিত্বের মানসিকতায় গড়ে উঠেছে, শ্রমিক মালিকের হাত ধরে ঐসব প্রতিষ্ঠান যুগের পর যুগ টিকে আছে। বিকশিত হচ্ছে। ভারতের টাটা গ্রুপ এক্ষেত্রে আমাদের উদাহরণ হতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানে যে বা যারা কাজ করছে, কেউ নিজেদের কর্মী ভাবছে না। বরং মালিকপক্ষের অংশ ভেবে নিজের সক্ষমতার পুরোটাই উজাড় করে দিচ্ছে। এ ধরনের কর্পোরেট সংস্কৃতি আমাদের উদীমান বেসরকারিখাতে স্বল্প পরিসরে লক্ষ্য করা গেলেও অধিকাংশই শোষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কর্মী মালিকের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে না। এটি বেসরকারিখাতের বিকাশের পথকে এক সময় রুদ্ধ করে দেবে।
দক্ষ হাত সক্ষমতার পরিপূরক। এ সত্য উপলব্ধি আমাদের মালিকপক্ষ যতোদিন বুঝতে ব্যর্থ হবেন, ততোদিন আমরা টাটা গ্রুপের উদাহরণে পৌঁছতে পারবো না।
 বাংলাদেশে বেসরকারিখাতের বিকাশে দক্ষ জনবল হিসেবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বরং নি¤œ বেতন ও পদবী নির্ধারণ, যখন তখন ছাঁটাইয়ে ভয় তাদেরকে নিত্য তাড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অবকাঠামো নির্মাণ, আবাসন, সড়ক ও সেতু নির্মাণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে যে উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেখানে মূল কুশীলব হিসেবে কাজ করছে মধ্যম স্তরের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীগণ। এই বিশাল কর্মীবাহিনীর চাকরি নিশ্চয়তা, ন্যূনতম বেতন ভাতাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। অসংগঠিত এই বিশাল প্রকৌশলী নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন না থাকায় ব্যক্তি মালিকগণ তাদের বিভিন্নভাবে শোষণ ও বঞ্চনা করে যাচ্ছেন। সংগঠিত না থাকায় এই শোষণ ও বঞ্চনার উত্তরণে তারা সোচ্চার হতে পারছে না। যেভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে শোষণ থাকতে পারে না। এই ভাবনা থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অভিভাবক সংগঠন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)’র সার্বিক দিক নির্দেশনায় প্রাইভেট সেক্টরের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে গঠন করা হয় ‘প্রাইভেট সেক্টর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ।
এই সংগঠনের পক্ষে বেসরকারিখাতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ, বেতন ভাতা ও পদবী নির্ধারণ, কর্ম নিশ্চয়তা, আনুষঙ্গিক প্রাপ্তির সুনিশ্চিতকরণ ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইন কঠোরভাবে প্রতিপালনের সহযোগিতা চেয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি-বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার শিল্প মালিক ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সাথে আলোচনা করে শীঘ্রই একটা সমাধানে আসবেন। মালিক ও দক্ষ কর্মীর সেতু বন্ধনে অগ্রসরমান বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে পৌঁছবে আপন মহিমায়। সেটাই বেসরকারিখাতে কর্মরত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একান্ত প্রত্যাশা।
 লেখক : প্রকৌশলী নাজিমুদ্দিন পাটোয়ারী
( সাধারণ সম্পাদক, প্রাইভেট সেক্টর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ )